দীঘার 'জগন্নাথ ধাম' নিয়ে শাস্ত্র ও রাজনীতির সংঘাত! মহারাজার আপত্তিতে রথযাত্রার আগে অস্বস্তিতে মমতা?
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প, দীঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দির, রথযাত্রার প্রাক্কালে এক তীব্র শাস্ত্রীয় ও রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পুরীর আদলে তৈরি এই মন্দিরকে 'জগন্নাথ ধাম' হিসেবে প্রচার করা নিয়ে সরাসরি আপত্তি জানিয়েছেন পুরীর গজপতি মহারাজা দিব্যসিংহ দেব। তিনি এই উদ্যোগকে 'শাস্ত্র ও পরম্পরা বিরোধী' আখ্যা দেওয়ায় রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিরোধীরা, বিশেষত বিজেপি, মহারাজার বক্তব্যকে হাতিয়ার করে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত এবং শাস্ত্রকে অপমান করার অভিযোগ তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে, দীঘাকে পুরীর বিকল্প তীর্থক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরার রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টা এক বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

কলকাতা/পুরী: সৈকত নগরী দীঘার বুকে মাথা তুলেছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে এক সুবিশাল মন্দির। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নির্মিত এই মন্দিরকে ঘিরে পর্যটন ও ধর্মীয় ভাবাবেগের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিল রাজ্য। কিন্তু রথযাত্রার ঠিক আগেই সেই স্বপ্নে লাগল বড়সড় ধাক্কা। সরাসরি পুরীর শ্রীক্ষেত্র থেকে ভেসে এল আপত্তির সুর। খোদ পুরীর গজপতি মহারাজা দিব্যসিংহ দেব দীঘার এই মন্দিরকে 'জগন্নাথ ধাম' বলার প্রচেষ্টা এবং নির্মাণশৈলীর কিছু দিককে 'শাস্ত্র ও পরম্পরা বিরোধী' বলে অভিহিত করায় এক নতুন এবং জটিল বিতর্কের সূচনা হয়েছে। এই ঘটনা শুধুমাত্র ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানকেও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু: ‘ধাম’ শব্দের ব্যবহার এবং শাস্ত্রীয় আপত্তি
কিছুদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে দীঘার এই জগন্নাথ মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করেন। সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে পুরীর মন্দিরের একটি প্রতিরূপ এবং বাংলার নিজস্ব 'জগন্নাথ ধাম' হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালানো হয়। লক্ষ্য ছিল, বাংলার অগণিত জগন্নাথ ভক্ত, যাঁরা প্রতি বছর পুরী যেতে পারেন না, তাঁরা যেন দীঘাতেই শ্রীক্ষেত্রের অনুভূতি পান। কিন্তু গোল বেঁধেছে এই 'ধাম' শব্দটির ব্যবহার নিয়েই।
পুরীর গজপতি মহারাজা দিব্যসিংহ দেব, যিনি জগন্নাথ সংস্কৃতির প্রধান সেবক এবং বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এক ব্যক্তিত্ব, এক সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে তাঁর তীব্র উষ্মা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “দারুব্রহ্ম রূপে ভগবান জগন্নাথের আবির্ভাব হয়েছিল শ্রীক্ষেত্র পুরুষোত্তম ক্ষেত্র পুরীতে। তাই একমাত্র এই স্থানকেই জগন্নাথ ধাম বলা হয়। আমি আশ্চর্য এবং দুঃখিত দীঘার ঘটনায়। বিশ্বজুড়ে জগন্নাথ দেবের বহু মন্দির তৈরি হয়েছে, কিন্তু কেউই নিজেদের স্থানকে 'জগন্নাথ ধাম' আখ্যা দেয়নি।”
তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, “দীঘায় এত সুন্দর ও সুবৃহৎ মন্দির তৈরি হয়েছে, এটা খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যে কাজ ওখানে হয়েছে, তা শাস্ত্র ও পরম্পরার বিরোধী।” মহারাজার এই মন্তব্যের পরেই সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং জগন্নাথ সংস্কৃতির গবেষকদের মধ্যে যে বিতর্ক চলছিল, তা সর্বসমক্ষে চলে আসে।
তাঁদের মতে, 'ধাম' শুধুমাত্র একটি মন্দির বা স্থান নয়। এটি একটি দিব্যক্ষেত্র, যেখানে ঈশ্বরের নিত্যলীলা প্রকাশিত হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র পুরীই একমাত্র জগন্নাথ ধাম। অন্য কোনও স্থানে নির্মিত মন্দিরকে 'জগন্নাথ মন্দির' বলা যেতে পারে, কিন্তু 'ধাম' বলা শাস্ত্রসম্মত নয়। তাঁদের অভিযোগ, রাজ্য সরকার জনপ্রিয়তা এবং রাজনৈতিক লাভের জন্য শাস্ত্রীয় এই সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষা করেছে।
রাজনৈতিক তরজা: তৃণমূল বনাম বিজেপি
পুরীর মহারাজার এই মন্তব্যকে হাতিয়ার করতে এক মুহূর্তও দেরি করেনি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। প্রথম থেকেই বিজেপি দীঘার এই নির্মাণকে 'মন্দির' না বলে 'সাংস্কৃতিক কেন্দ্র' বা 'ইকো-ট্যুরিজম হাব' বলে কটাক্ষ করে আসছিল। এবার তারা মহারাজার বক্তব্যকে সামনে রেখে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “পুরীর মহারাজা ঠিক কথাই বলেছেন। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, শাস্ত্রকে অমান্য করে, হিন্দু সনাতনীদের সংস্কৃতিকে অপমান করে দীঘায় এই মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। শুধুমাত্র পুরীর মন্দিরের পাল্টা একটি কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করেছে রাজ্য সরকার। হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ দেবকে ব্যবহার করে এই শাস্ত্র বিরোধী কাজ করেছেন। মহারাজা তাঁর মুখোশ খুলে দিয়েছেন।”
বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যও এই বিষয়ে টুইট করে বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অহংকার এবং হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতা আবারও প্রমাণিত হল। তিনি শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রচারের জন্য একটি মন্দির তৈরি করতে পারেন, কিন্তু তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। পুরীর গজপতির মন্তব্যই তার প্রমাণ।"
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগকে 'বিজেপির চক্রান্ত' বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, “বিজেপির কাজই হল ভালো কাজের মধ্যে খুঁত খুঁজে বেড়ানো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মানুষের ভাবাবেগকে সম্মান জানিয়ে দীঘায় এই भव्य মন্দির তৈরি করেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ উপকৃত হবেন। পুরীর মহারাজা তাঁর ব্যক্তিগত মতামত জানিয়েছেন, যা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনেছি। কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। বিজেপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, আমরা করি না।”
মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ এবং দীঘার রথযাত্রা
এই বিতর্কের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীঘার রথযাত্রাকে এক বিশাল উৎসবে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। রথযাত্রার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে তিনি নিজে দীঘায় গিয়েছেন এবং প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সরকারের লক্ষ্য, পুরীর পাশাপাশি দীঘাতেও রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটানো। এর মাধ্যমে দীঘাকে শুধুমাত্র একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের প্রধান তীর্থক্ষেত্রগুলির একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটি বৃহত্তর পরিকল্পনা রয়েছে।
কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গজপতি মহারাজার এই মন্তব্যের পর সেই পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে এক বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে। যে সনাতনী ভাবাবেগকে পুঁজি করে তৃণমূল সরকার এগোতে চাইছিল, সেই ভাবাবেগেই আঘাত লেগেছে বলে মনে করছেন অনেকে। মহারাজার আপত্তির পর, বহু নিষ্ঠাবান ভক্ত দীঘার মন্দিরকে পুরীর সমতুল্য হিসেবে দেখতে দ্বিধা বোধ করতে পারেন, যা সরকারের মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করবে।
শুধুমাত্র রাজনীতি নয়, রয়েছে ভাবাবেগ ও পরম্পরার প্রশ্ন
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, মন্দির নির্মাণ বা ধর্মীয় উদ্যোগ শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা বা আর্থিক বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে না। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শত শত বছরের শাস্ত্রীয় বিশ্বাস, পরম্পরা এবং লক্ষ কোটি মানুষের ভাবাবেগ। দীঘার মন্দির নিঃসন্দেহে একটি স্থাপত্যের নিদর্শন এবং এটি রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে একটি নতুন পালক যোগ করবে। কিন্তু তাকে 'দ্বিতীয় পুরী' বা 'জগন্নাথ ধাম' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ এবং পরম্পরার দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে। রথযাত্রার আগে এই বিতর্ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে যে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা বলাই বাহুল্য। এখন দেখার, রাজ্য সরকার এই শাস্ত্রীয় বিতর্ককে কীভাবে সামাল দেয় এবং দীঘার মন্দিরের ভবিষ্যৎ পরিচয় কোন পথে চালিত হয়।
What's Your Reaction?






