জগন্নাথের প্রসাদ নিতে অস্বীকার করায় যুবককে নৃশংস মারধর? বারুইপুরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, শুভেন্দুর ‘জেহাদি’ মন্তব্যে তোলপাড় রাজনীতি

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উপলক্ষে প্রসাদ গ্রহণ করতে না চাওয়ায় পুলক কয়াল নামে এক যুবককে বাঁশ, রড দিয়ে নৃশংসভাবে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই যুবক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই ঘটনায় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দায়ী করে এটিকে 'জেহাদি কার্যকলাপ' বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আহত যুবকের রক্তাক্ত ভিডিও পোস্ট করে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, অভিযুক্তরা মাসখানেক আগে স্থানীয় একটি হনুমান মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাতেও জড়িত ছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বারুইপুর এলাকায় তীব্র সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

Jun 27, 2025 - 02:12
 0  19
জগন্নাথের প্রসাদ নিতে অস্বীকার করায় যুবককে নৃশংস মারধর? বারুইপুরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, শুভেন্দুর ‘জেহাদি’ মন্তব্যে তোলপাড় রাজনীতি

বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা: রথযাত্রার উৎসবের আবহের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক হিংসার অভিযোগে উত্তপ্ত হয়ে উঠল দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর। জগন্নাথ দেবের প্রসাদ নিতে অস্বীকার করায় পুলক কয়াল নামে এক যুবককে প্রাণনাশের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। বাঁশ, লোহার রড এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর উপর নৃশংস হামলা চালানো হয় বলে দাবি পরিবারের। বর্তমানে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কলকাতার এক হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন ওই যুবক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দিকে আঙুল তুলেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গকে 'জেহাদিদের মুলুক' বলে কটাক্ষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন।

ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে?

স্থানীয় সূত্রে এবং পুলক কয়ালের পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী, ঘটনার সূত্রপাত রথযাত্রার দিন। বারুইপুর থানা এলাকার অন্তর্গত কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামে রথযাত্রা উপলক্ষে প্রসাদ হিসেবে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছিল। অভিযোগ, সেই সময় ইলিয়াস শেখ, রহিম মোল্লা, করিম মোল্লা এবং রহমান মোল্লা নামে চার ব্যক্তি পুলক কয়ালকে জোর করে প্রসাদ গ্রহণ করতে বলেন। পুলক তাতে আপত্তি জানান এবং প্রসাদ নিতে অস্বীকার করেন।

পুলকের পরিবারের দাবি, শুধুমাত্র প্রসাদ নিতে অস্বীকার করার কারণেই ওই চারজন প্রথমে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। সেই মুহূর্তে স্থানীয়দের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হলেও, বিদ্বেষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল।

পরিকল্পিত হামলা ও নৃশংস অত্যাচার

অভিযোগ, হুমকির ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই পরের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালে পুলকের উপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়। পুলক যখন স্থানীয় একটি পুকুরে স্নান করতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় অভিযুক্তরা পথ আটকে তাঁর উপর চড়াও হয়। বাঁশ, লোহার রড এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁকে এলোপাথাড়ি মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। আক্রান্ত যুবক পুলক কয়াল হাসপাতালের বেড থেকে কোনওরকমে জানান, তিনজন মিলে তাঁকে ঘিরে ধরেছিল এবং মোটা লাঠি দিয়ে মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। তাঁর দাবি, তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোরও চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু কোনওভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

তাঁর আর্তচিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে এলে অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় পুলককে উদ্ধার করে প্রথমে বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাঁর অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় এবং মাথায় গুরুতর আঘাত থাকায় চিকিৎসকরা তাঁকে কলকাতার একটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পরামর্শ দেন। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন।

শুভেন্দু অধিকারীর 'এক্স' বোমা ও রাজনৈতিক তরজা

ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম 'এক্স' (পূর্বতন টুইটার)-এ আহত পুলক কয়ালের একটি হাড়হিম করা ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, পুলকের নাক ও মুখ দিয়ে অনর্গল রক্ত ঝরছে, জামাকাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছে এবং দুজন ব্যক্তি তাঁকে ধরে শুশ্রূষা করার চেষ্টা করছেন।

এই ভিডিও পোস্ট করে শুভেন্দু অধিকারী সরাসরি রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে আক্রমণ করেন। তিনি লেখেন, “পশ্চিমবঙ্গ কি জেহাদিদের মুলুকে পরিণত হয়েছে? দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে পুলক কয়াল নামে এক হিন্দু যুবককে নির্মমভাবে মারধর করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ? তিনি মহাপ্রভু জগন্নাথের নামে দেওয়া প্রসাদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন, “ইলিয়াস শেখ, রহিম মোল্লা, করিম মোল্লা এবং রহমান মোল্লার নেতৃত্বে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এই হামলা চালিয়েছে। এরা সকলেই গত মাসে কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামের বজরংবলী মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনায় অভিযুক্ত ছিল এবং জামিনে মুক্ত।” শুভেন্দুর অভিযোগ, পুলিশ সেই সময় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি বলেই তাদের সাহস এতটা বেড়েছে। তিনি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার এবং কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

অভিযুক্তদের অতীত এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ এই ঘটনাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। তাঁর দাবি অনুযায়ী, অভিযুক্তরা শুধুমাত্র এই ঘটনাতেই নয়, মাসখানেক আগে স্থানীয় একটি হনুমান মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনাতেও অভিযুক্ত ছিল। সেই সময় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করলেও, তারা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, শাসকদলের ছত্রছায়ায় থাকার কারণেই পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে হালকা ধারায় মামলা রুজু করেছিল, যার ফলে তারা দ্রুত ছাড়া পেয়ে যায়। বারবার একই অভিযুক্তদের দ্বারা এই ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ঘটনা ঘটায় পুলিশের ভূমিকা এবং রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের আশঙ্কা

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বারুইপুরের কাঁঠালবেড়িয়া এবং সংলগ্ন এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি ইতিমধ্যেই এই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছে। তাদের অভিযোগ, একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে তোষণ করার রাজনীতির ফলেই পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগে বারবার আঘাত করা হচ্ছে এবং তাঁদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় পুলিশি টহলদারি বাড়ানো হয়েছে।

তদন্তের বর্তমান অবস্থা

বারুইপুর থানার পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। আহত যুবকের পরিবারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট চারজনের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে, তবে এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, "আমরা সমস্ত দিক খতিয়ে দেখছি। পুরনো মন্দির ভাঙচুরের ঘটনার সঙ্গে এর কোনও যোগ আছে কিনা, সেটাও তদন্তের পরিধিতে রয়েছে। দোষীদের খুব শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে।"

তবে বিরোধী এবং স্থানীয়দের একাংশের মতে, পুলিশি তদন্তের উপর তাদের কোনও ভরসা নেই। তাদের দাবি, অতীতেও যেমন অভিযুক্তরা ছাড় পেয়ে গিয়েছে, এবারও হয়তো তাই হবে। এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির এক ভয়ঙ্কর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে, যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত পছন্দের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলিও হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পুলক কয়ালের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এবং দোষীদের শাস্তিই এখন প্রশাসনের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

Tathagata Reporter