‘আমি খুনি নই, আমি ভুক্তভোগী’: কর্নাটকে ‘মৃত’ স্ত্রীর আবির্ভাবে চাঞ্চল্য, বিচারব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিলেন জেলখাটা স্বামী

কর্ণাটকের কোডাগু জেলার এক আদিবাসী ব্যক্তি, কুরুবারা সুরেশ, প্রায় দুই বছর ধরে স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে কারাবাসের পর এখন ন্যায়বিচারের দাবিতে কর্ণাটক হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর 'মৃত' স্ত্রী মালিগেকে সম্প্রতি জীবিত অবস্থায় খুঁজে পাওয়ার পর এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। সুরেশ কেবল তাঁর নির্দোষ মুক্তির জন্যই লড়ছেন না, বরং যে পুলিশি তদন্তের ভুলে তাঁকে এই দুঃসহ পরিস্থিতি ভোগ করতে হয়েছে, সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন। তিনি পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ এবং তদন্তের গাফিলতির জন্য দায়ী পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন। এই মামলাটি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ভুলবশত কারাবাসের কাহিনী নয়, বরং ভারতের বিচার ব্যবস্থায় তদন্তকারী সংস্থাগুলির দায়বদ্ধতা এবং নিরপরাধ নাগরিকের অধিকার রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের নিদর্শন হয়ে উঠেছে।

Jun 27, 2025 - 01:56
 0  4
‘আমি খুনি নই, আমি ভুক্তভোগী’: কর্নাটকে ‘মৃত’ স্ত্রীর আবির্ভাবে চাঞ্চল্য, বিচারব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিলেন জেলখাটা স্বামী

বেঙ্গালুরু, ভারত: যে স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে তিনি প্রায় দুই বছর জেল খেটেছেন, সেই স্ত্রী জীবিত এবং অন্য পুরুষের সঙ্গে সংসার করছেন। এই চরম নাটকীয় সত্য উন্মোচিত হওয়ার পর, কর্ণাটকের এক আদিবাসী ব্যক্তি, কুরুবারা সুরেশ, এখন নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া সময় এবং সম্মানের মূল্য চাইছেন। বিচারব্যবস্থার এক মারাত্মক ভুলের শিকার সুরেশ, কর্ণাটক হাইকোর্টে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করে এক অভূতপূর্ব আইনি লড়াই শুরু করেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপ কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতিপূরণের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার গাফিলতির বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ।

কুশলনগর তালুকের বাসভানাহল্লির বাসিন্দা সুরেশের জীবন এক লহমায় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ২০২৫ সালের এপ্রিলে মাইসুরুর পঞ্চম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত তাঁকে সমস্ত অভিযোগ থেকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়ার পর, সুরেশ এখন তাঁর পরিণতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর। দায়রা আদালত তাঁকে নামমাত্র এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও, সুরেশের মতে এটি তাঁর প্রতি হওয়া অন্যায়ের তুলনায় অত্যন্ত সামান্য। তাই তিনি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।

কী ঘটেছিল সুরেশের সঙ্গে? এক নির্দোষ ব্যক্তির কারাবাসের কাহিনী

ঘটনার সূত্রপাত ২০২১ সালে। সুরেশের স্ত্রী, মালিগে, হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। উদ্বিগ্ন স্বামী হিসেবে সুরেশ নিজেই কুশলনগর গ্রামীণ থানায় নিখোঁজ ডায়েরি দায়ের করেন। কিন্তু এই সাধারণ নিখোঁজ ಪ್ರಕರಣটিই যে তাঁর জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের সূচনা করতে চলেছে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।

২০২২ সালে, পার্শ্ববর্তী মাইসুরু জেলার বেত্তাদাপুরা থানার পুলিশ একটি কঙ্কালসার দেহাবশেষ উদ্ধার করে। কোনও সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই, পুলিশ অনুমান করে নেয় যে দেহটি মালিগের। এখানেই তদন্তের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় গাফিলতির সূত্রপাত হয়। পুলিশি তদন্তের বয়ান অনুযায়ী, সুরেশের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে বিবাদ ছিল এবং তারই জেরে তিনি মালিগেকে খুন করে দেহ লোপাট করে দেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা সুরেশ এবং তাঁর শাশুড়ি, অর্থাৎ মালিগের মা-কেও চাপ দিয়ে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাধ্য করে বলে অভিযোগ। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, পরবর্তীকালে ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে ওই কঙ্কালের সঙ্গে মালিগের মায়ের ডিএনএ-র কোনও মিল নেই। কিন্তু সেই রিপোর্টকে উপেক্ষা করেই পুলিশ সুরেশের বিরুদ্ধে খুনের মামলা সাজায় এবং তাঁকে ২০২২ সালের ২২শে মে গ্রেপ্তার করে।

সুরেশের আইনজীবী, বি.এস. পাণ্ডু পূজারীর অভিযোগ, তাঁর মক্কেলকে পুলিশি হেফাজতে অকথ্য নির্যাতন করে খুনের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। সুরেশ বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও, পুলিশি চার্জশিটের ভিত্তিতে তাঁকে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো হয়। প্রায় ১৮ মাস তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন এক এমন অপরাধের জন্য যা কখনও ঘটেইনি।

নাটকীয় মোড়: ‘মৃত’ স্ত্রীর প্রত্যাবর্তন

২০২৫ সালের এপ্রিল মাস। সুরেশ তখন সবেমাত্র জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। একদিন তাঁর বন্ধুরা মাদিকেরির একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে চমকে ওঠেন। তাঁরা দেখেন, ‘মৃত’ মালিগে অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে বসে খাবার খাচ্ছেন। বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করেন এবং সুরেশকে জানান।

এই অকল্পনীয় প্রমাণ হাতে পেয়ে সুরেশ আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালতের নির্দেশে, বেত্তাদাপুরা পুলিশ মালিগেকে আটক করে এবং মাইসুরুর আদালতে হাজির করে। আদালতে দাঁড়িয়ে মালিগে স্বীকার করেন যে তিনি সুরেশকে ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন এবং অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে শেট্টিহাল্লি গ্রামে বসবাস করছিলেন, যা মাদিকেরি থেকে মাত্র ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে। তিনি আরও জানান যে সুরেশের কারাবাসের বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না।

মালিগের এই জীবন্ত উপস্থিতি গোটা মামলাকে এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ করে দেয়। যে খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত বড় তদন্ত, গ্রেপ্তার এবং কারাবাস—তার কোনও অস্তিত্বই ছিল না।

দায়রা আদালতের রায় এবং সুরেশের অসন্তোষ

২০২৫ সালের ২৩শে এপ্রিল, মাইসুরুর পঞ্চম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারক গুরুরাজ সোমাক্কালভার এক ঐতিহাসিক রায়ে সুরেশকে সসম্মানে নির্দোষ ঘোষণা করেন। আদালত পুলিশের তদন্তকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ এবং ‘ভিত্তিহীন’ বলে তীব্র ভর্ৎসনা করে। বিচারক তাঁর রায়ে বলেন, “বিচারব্যবস্থাকে এক্ষেত্রে ভুল পথে চালিত করা হয়েছে।”

আদালত কর্ণাটক স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে সুরেশকে এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এছাড়াও, শুধুমাত্র তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর প্রকাশ বিজি-র বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাট এবং মিথ্যা মামলা সাজানোর জন্য ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।

কিন্তু এই রায়ে সুরেশ সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁর মতে, শুধুমাত্র একজন জুনিয়র কর্মকর্তাকে দায়ী করে বাকি সিনিয়র কর্মকর্তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে, যাঁরা এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার ছিলেন। তাঁর জীবনের যে মূল্যবান সময় এবং সম্মান নষ্ট হয়েছে, তার তুলনায় এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণকে তিনি ‘উপহাস’ বলে মনে করেন।

উচ্চ আদালতে নতুন লড়াই: ন্যায়বিচারের অন্বেষণ

এই অসন্তোষ থেকেই সুরেশ কর্ণাটক হাইকোর্টে একটি ফৌজদারি আপিল দায়ের করেছেন। তাঁর আবেদনে তিনি পাঁচটি মূল দাবি জানিয়েছেন:

১. ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধি: ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এক লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ কোটি টাকা করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, তাঁর মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক ক্ষতির পরিমাণ অর্থের অঙ্কে পরিমাপ করা কঠিন।

২. সকল দোষী কর্মকর্তার শাস্তি: তিনি শুধুমাত্র ইন্সপেক্টর প্রকাশ বিজি নন, বরং তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিতেন্দ্র কুমার, উপ-পরিদর্শক প্রকাশ যত্তিমণি এবং মহেশ বিকে, এবং সহকারী উপ-পরিদর্শক সোমশেখর—এই পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করেছেন। তাঁর অভিযোগ, এঁরা সকলেই প্রমাণ তৈরি, পদের অপব্যবহার এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই তাঁকে গ্রেপ্তারের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

৩. পরিচয়ের সংশোধন: দায়রা আদালতের রায়ে তাঁকে ‘অভিযুক্ত’ (accused) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরেশ এই শব্দটি পরিবর্তন করে তাঁকে ‘ভুক্তভোগী’ (victim) হিসেবে বর্ণনা করার জন্য আদালতের কাছে অনুরোধ করেছেন। তাঁর যুক্তি, “আমি কোনও অপরাধ করিনি, আমি ব্যবস্থার শিকার হয়েছি। তাই আমি অভিযুক্ত নই, ভুক্তভোগী।”

৪. স্বতন্ত্র তদন্ত: গোটা ঘটনার একটি নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তদন্তের দাবি করেছেন তিনি।

৫. অজ্ঞাত কঙ্কালের পরিচয়: বেত্তাদাপুরায় প্রাপ্ত কঙ্কালটি কার, সেই রহস্য উদঘাটনের জন্য যথাযথ তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন সুরেশ।

এক পরিবারের ধ্বংসের কাহিনী

এই আইনি লড়াইয়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি পরিবারের ভেঙে যাওয়ার করুণ কাহিনী। সুরেশ যখন জেলে ছিলেন, তখন তাঁর সংসার ভেসে গিয়েছিল। তাঁর ছেলে কৃষ্ণ দশম শ্রেণীতে এক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পরিবারের ভরণপোষণ এবং বোনের পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য সে কাজে যোগ দেয়।

তবে এই অন্ধকারের মধ্যেও এক চিলতে আলো নিয়ে এসেছে সুরেশের মেয়ে জে.এস. কীর্তি। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও সে এসএসএলসি পরীক্ষায় ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে, যা তাঁর বাবার লড়াইকে নতুন শক্তি জুগিয়েছে। সুরেশ বলেন, “আমি আমার ছেলের পড়াশোনাও আবার শুরু করাব। এই লড়াই শুধু আমার একার নয়, আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্যও।”

উপসংহার: একটি মাইলফলক মামলার প্রতীক্ষা

কুরুবারা সুরেশের এই মামলাটি এখন কর্ণাটক তথা সমগ্র ভারতের বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে একজন নিরপরাধ নাগরিকের জীবন কীভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, এই ঘটনা তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। হাইকোর্ট যদি সুরেশের পক্ষে রায় দেয়, তবে তা কেবল একজন ব্যক্তির জয় হবে না, বরং এটি ভুলবশত কারাবাস এবং বিদ্বেষমূলক মামলার (malicious prosecution) শিকার হওয়া অগণিত মানুষের জন্য এক নতুন আশার আলো দেখাবে। এই মামলার রায়ই নির্ধারণ করবে, ভারতে একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনের মূল্য এবং সম্মান রাষ্ট্রীয় ভুলের কাছে কতটা সুরক্ষিত। গোটা দেশ এখন কর্ণাটক হাইকোর্টের দিকে তাকিয়ে, এক ঐতিহাসিক রায়ের অপেক্ষায়।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

Tathagata Reporter